- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****দেখ শালা কত বড় “ক”?*****
মূল লেখকঃ আফতাব হোসেন।
মূল লেখকঃ আফতাব হোসেন।
কোরবানির ঈদ চলে এসেছে। আর মাত্র কদিন বাকি। চারিদিকে মাইকিং, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। বিরাট গরু ছাগলের হাট। সাথে নানা রকম সুযোগ সুবিধার বর্ণনা। শ্রাবণের অঝোর ধারাকে উপেক্ষা করে, এক হাঁটু কাদা পায়ে মেখে মানুষ ঘুরে ফিরছে হাট থেকে হাটে। কেউ কেউ যায় দূর দূরান্তের গ্রামে, গৃহস্থের কাছ থেকে পছন্দের গরু কিংবা ছাগলটি কিনতে। কোরবানি করতে আল্লাহর নামে!
আমি বসে বসে শ্রাবণের মেঘ দেখি, মেঘেদের কান্না শুনি। বিরাট গরু ছাগলের হাটে যাবার আমার কোনো তাড়া নেই। প্রতি বছর কত অযুত কোটি পশু কোরবানি হয়। তবু কেন বিধাতা তুষ্ট নয়? তবু কেন অতি খরা, অতি বৃষ্টি? তবু কেন এত অনাসৃষ্টি? তবু কেন পুড়ে যায় কৃষকের ক্ষেতের ধান? কেন এডিস মশা কেঁড়ে নেয় নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ? আমি বসে বসে মনের আয়নায় নিজেকে দেখি। আর ভাবি, কতটুকু আমার আসল আর কতটুকু মেকি? এমন সময় বউ এসে জানতে চায়,
- তুমি দেখি ঘরে বসে আছ। কোরবানির গরু কিনবা না?
- হুম, কিনব তো!
আমি আনমনে বলি,
- আর কবে কিনবা? ঈদ তো চলে এলো।
- কিনব রে বউ। বৃষ্টি বাদলার দিন, আমার বাড়িতে তো গরু রাখার ব্যবস্থা নাই যে আল্লাহর নামে কেনা পশুটাকে ভালো মত থাকতে দেব। আবার লোক বলও নাই যে তার দেখভাল করবে। কেন মিছেমিছি নিরীহ পশুটিকে বাড়িতে এনে কষ্ট দেব? তাই ভাবছি, ঈদের আগের দিনই কিনব। ততদিন নাহয় সে তার মালিকের কাছেই আদর যত্নে থাক।
- তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু দুএকটা হাটে ঘুরলে ধারণা তো হয়, গরুর দরদাম কেমন যাচ্ছে।
- ধারণা হয়ে কী লাভ?
- বুদ্ধু কী আর তোমারে সাধে বলি? দরদাম না জানলে তোমারে গরুর বেপারীরা ঠকায়া দেবে না?
- আরে পাগলী, আমি তো গরু কিনব আল্লাহর জন্য। ঠকলে তো আল্লায় ঠকবে, আমি ঠকব কেমন করে?
- তোমার মারফতি কথা আমি বুঝি না। আল্লাহর জন্য তো অবশ্যই কিনবা। কিন্তু কিনবা তো তোমার পয়সা দিয়া। দাম বেশী পড়লে তোমার ঠকা হইল না?
- না, হইল না। আসো, তোমারে বুঝাইয়া দিই। তুমি যখন তোমার ছেলের পছন্দের ব্রান্ডের কাপড় কেনো, তখন কী দামের দিকে তাকাও? তাকাও না। তোমার চিন্তায় কেবল তোমার ছেলের পছন্দই প্রাধান্য পায়। আর আমি কিনব আমার স্রষ্টার জন্য, তার বলে দেয়া মানদণ্ড অনুযায়ী। সেখানে লাভ লোকসানের হিসেব করলে স্রষ্টার পছন্দকে ছোট করে দেখা হয়ে গেল না? তাছাড়া আমি তো আর গোসত বিক্রি করতে যাচ্ছি না, যে বেশী টাকা দিয়ে কিনলে আমার লস হবে আর কম টাকা দিয়ে কিনলে লাভ হবে।
- ও! তুমি তো আবার বেশী বোঝো! তা এবার কও দেখি, তুমি কোরবানির গোসত মাপতে দেও না ক্যান? এর মোজেজাটা কী? সবাই কোরবানির পর বলে, কার কত মন গোসত হল, আমি কিছুই বলতে পারি না।
এবার আমি হেসে ফেলি। কোরবানির আগে একটাই আলোচনা চলে, কার গরুর কত দাম পড়ল? দেশি না বিদেশী? ছোটবেলায় নানার সাথে হাঁট থেকে ইলিশ মাছ কিনে বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ে। পথে হেন কেউ ছিল না, যে দেখে জিজ্ঞেস করেনি, “খোনহার সাইব, মাছ কত পরলে?” তেমনই রাস্তা দিয়ে এখন কোনো গরু নিয়ে যেতে দেখলেই সবাই জিজ্ঞেস করবে, “কত পড়ল?” আর কোরবানির পর চলে চুলচেরা আলোচনা, কার গরুতে কত মন গোসত হল। কে জিতল, আর কে ঠকল? আমি হেসে বলি,
- তিনটা কারণে। প্রথমত, যখনই তুমি জানবে, কত কেজি গোসত হল, তখনই মনে মনে গরুর মূল্যকে কেজি দিয়ে ভাগ করে ফেলবে। আর বোঝার চেষ্টা করবে, কসাইয়ের কাছে থেকে কেনার চেয়ে লাভ হল না লস হল। আর তখনই যে উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হল, অর্থাৎ ত্যাগ কিংবা স্যাক্রিফাইস, সেটা নষ্ট হয়ে গেল, হয়ে গেল গোসত বাণিজ্য। দ্বিতীয়ত, যখনই তুমি পাশের বাড়ির গরুতে কত মন গোসত হল আর তোমার গরুতে কত মন গোসত হল তুলনা করবে, তখন যদি দেখো, পাশের বাড়িরে গরুর চেয়ে তোমার গরুর গোসতের দাম বেশী পড়েছে, অনুতাপে তোমার মনটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাবে। আল্লাহর সন্তুষ্টিরে জন্য কিছু করে যদি তুমি অনুতপ্ত হও, সেখানে আর যাই থাক, আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে না। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, যখনই তুমি বলবে, তোমার কোরবানির গরুতে এত মন গোসত হয়েছে, তখনই তোমার ভেতর এক ধরনের অহংকার ও রিয়া বা প্রদর্শোনেচ্ছা প্রকাশ পাবে, অমনি তোমার পুরা কোরবানি নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এই রিস্কটা কী করে নিই বলো?
- কিন্তু অনেকেই তো বলে, গোসত তারা মাপার জন্য মাপে না, তারা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে সমান ভাগ করে, যাতে কম বেশী না হয়।
- সমান ভাগে ভাগ করার জন্য দাঁড়িপাল্লা লাগলেও বাটখারা লাগে না। অর্থাৎ বাটখারা দিয়ে ওজন না করেও নিখুঁত ভাবে ভাগ করা যায়। যারা এটা বলে, তারা নিজেরাই নিজেদের ধোঁকা দেয়।
- তাই তো! ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখিনি।
- আরও আছে। দুদিন পরেই দেখবে, পত্রিকার শিরোনামে গরু। কোন গরুটা সর্বোচ্চ কত দামে বিক্রি হল? প্রথম পাতার অর্ধেক জুড়ে সেই গরুর ছবি, সাথে হয়ত ক্রেতারও ছবি এবং পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত। নুসরাত, মিন্নি, এডিস মশাকে টপকে রাতারাতি গরু আমাদের সাংবাদিকদের কল্যাণে জাতীয় চরিত্র হয়ে যাবে। দেখবে, ফেসবুক ভরে গেছে গরুর ছবিতে। গরু-মানুষের সেলফিতে। কেউ কেউ তো গরুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে মহল্লার রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয়াবে, যেন গরুটা কমিশনার ইলেকশন জিতে গেছে।
- তোমার যত কথা। থাকো তুমি তোমার গরু নিয়া, আমি ঘুমাইতে গেলাম।
- একটু পরে যাও। তার আগে বলো, দেখ শালা কত বড় “ক”। কথাটা শুনেছ?
- হুম। শুনেছি, স্কুলের স্যাররা বলতেন। কিন্তু এর সাথে কোরবানির গরুর সম্পর্ক কী?
- আছে, আছে। সারা বছর পড়াশুনা না করে কোনো এক ছাত্র নাকি পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর না লিখে বড় বড় করে লিখে রেখেছিল, “দেখ শালা কত বড় ক”। নিজে পড়তে জানে না, অথচ টিচারকে “ক” চেনাচ্ছে! এখন দেখি, সারা বছর ইসলামের আর কোনো নিয়ম, হুকুম, আহকাম মানুক বা না মানুক, কোরবানি এলেই বিশাল এক গরু কিনছে। তার ছবি ফেসবুকে দিচ্ছে। অথবা সেই গরুকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শোভা যাত্রা করছে। আমি বুঝতে পারি না, কাকে এরা দেখাতে চায়, দেখ শালা কত বড় গরু? খোদাকে? মানুষকে? নাকি নিজেকে?
- পারও তুমি! ডাক্তারি বাদ দিয়া এতদিন প্রেমের গল্প লিখছ, কেউ কিছু বলেনি। এভাবে যদি ফতোয়া দেয়া শুরু করো, না জানি কবে হুজুররা তোমারে মুরতাদ ফতোয়া দিয়া দেশ ছাড়া করে!
- জানি না রে বউ। তবে আল্লাহ জানেন, বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেই আমি লিখি, কাউকে ছোট করার জন্য নয়।
কিছুক্ষণ আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বউ। তারপর আপন মনে মাথা নেড়ে শোয়ার ঘরে চলে যায়। হয়ত মনে মনে ভাবছে, এমন পাগলের সাথে বাস করা দায়।