- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****তবারকের মিষ্টি*****
মূল লেখকঃ আফতাব হোসেন।
মূল লেখকঃ আফতাব হোসেন।
একটা প্লেটে চারখানা জিলেপী এনে টেবিলে ঠক করে রাখতেই চমকে উঠি। দেখি গিন্নী দাঁড়িয়ে টেবিলের পাশে। জিলেপী আমার খুব প্রিয়। কড়া ভাজা মুচমুচে অথচ রসালো জিলেপীগুলো দেখেই আমার মুখে পানি এসে যায়। পরোক্ষণেই চোখ সরু করে গিন্নীর দিকে তাকাই। ডায়াবেটিস হয়নি এখনও। তবু আমার মিষ্টি খাবার উপর কড়া বিধি নিষেধ জারি করে রেখেছেন হার হাইনেস। চা খেতে দেয় সুক্রোল মিশিয়ে। কষ কষ লাগে। তবু বউয়ের মন রাখতে সেই বিস্বাদ চা সুস্বাদু হয়েছে বলে গিলতে হয়। ভাত খেতে দেয় উস্তে দিয়ে। ভয়ে সেই উস্তের তরকারিকেও মাঝে মাঝে মিষ্টি লাগে বলে ফেলি! আর মিষ্টি বলতে মাঝে সাঝে খেতে পাই সাদা দই। তাতে চিনি নেই বললেই চলে। সেই তিনি আজ একটা নয়, দুটা নয়, এক সাথে চার চারটে জিলেপী এনে রাখলেন! ডালমে জরুর কুছ কালা হায়! আমি ভাজা মাছটি উলটে খেতে পারি না ভাব দেখিয়ে নিরাসক্ত গলায় বলি,
- এত্তগুলা জিলাপী? ডায়াবেটিস হয়ে যাবে না?
- হবে না, তবারকের মিষ্টি। তুমি খাও।
গিন্নীর গলা বেশ নরম। একেবারে প্রথম আসমানে। এমনিতে গলা তাঁর সপ্তমে আসমানেই থাকে। একেবারে পারফেক্ট পারফেকশনিষ্ট বউ আমার। আর আমি হলাম এলেবেলে, বাউণ্ডুলে। জিনিষ পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি। বাইরে থেকে এসে ঘামে ভেজা চপচপে গেঞ্জিটা ওয়াশ বাস্কেটে না রেখে ভুল করে খাটের উপর ফেলি। বাত্তি জ্বালাইয়াই ঘুমাইয়া পড়ি। ফ্যান চালিয়ে রেখে বাইরে চলে যাই। এই সব দেখে দেখে তার মেজাজের গোঁড়ায় সারাক্ষণ ধিকিধিকি আগুন জ্বলে। আর প্রায়ই নানাবিধ শাস্তি জোটে আমার কপালে। তবে যেদিন তার মনটা নরম থাকে, মওকা বুঝে সেদিন আমিও দু এক হাত নিয়ে নিই। আজ এ সুযোগ হেলায় হারাতে চাইলাম না। হেসে বলি,
- ক্যান? তবারকের জিলাপী কি চিনির বদলে লবণ দিয়ে বানাইছে?
- মিলাদের মিষ্টিরে তাচ্ছিল্য করতে নাই। এইটা হইল তবারকের মিষ্টি। এর মরতোবা তুমি বুঝবা না।
অন্য দিন হলে ধর্মীয় ব্যাপারে ইয়ার্কি মারলে বউয়ের গলা এক লাফে তিন চার আসমান উপরে উঠে যেত। আজ তো উঠলই না, বরং মেঘ হয়ে আরও কাছে নেমে এলো। কী অদ্ভুত মানুষের বিশ্বাস! চায়ে এক চামচ চিনি খাওয়া যাবে না, অথচ তবারকের চার জিলেপী খেলে দোষ নাই। মিলাদ শেষে মিষ্টি কেন খেতে দেয়া হয়, তা আমার কাছে এক বিরাট রহস্য। মিষ্টির লোভে যারা মিলাদ পড়তে আসেন, তাঁদের দোয়া কতটুকু কাজে আসে, আল্লাহই ভালো জানেন। অন্যদের কথা জানিনা, আমার কথা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। ছোটো বেলায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমত না পড়লেও, জুম্মার নামাজে গুনে গুনে বাইশ রাকাত নামাজ ঠিক পড়ে ফেলতাম, কিংবা বলা যায় পড়তে হত। কারণ, নামাজ শেষে মিলাদ হবে। এক বা একাধিক মানুষেরা তাঁদের রোগ বালাই, বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পেতে মসজিদে প্যাকেট প্যাকেট জিলেপী, সাগর-পালা, দানাদার, পাঠিয়ে দিত। দোয়া পাবার আশায়। সেদিন বুঝতে পারতাম না, রোগ বালাই, বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন আল্লায়, আমাগো মিষ্টি খাওয়াইয়া কী লাভ?
শুনেছি, হুজুররাও মিলাদ পড়ানোর বিনিময়ে টাকা পান। ওনারা বলেন হাদিয়া। যার হাদিয়া যত বেশী, তাঁর দোয়াও ততো লম্বা। হাদিয়ার ওজন কল্পনা করে সেই অনুযায়ী মোনাজাতের সুর তোলেন। আমি জানি না, সেই সুর কত আসমান পর্যন্ত পৌঁছায়! তবে আমি যতদূর জানি, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত দোয়াই আল্লাহর কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য। অনুরোধের, তোষামোদের কিংবা বিনিময়ের দোয়া নয়। সাত বছর সৌদি আরবে থেকেছি। কোনদিন মিলাদের দাওয়াত পাই নাই। কেউ মিষ্টি খাওয়াইয়া দোয়া চায় নাই। অথচ বাংলাদেশে কথায় কথায় মিলাদ। বাচ্চা হলে মিলাদ, সেই বাচ্চা স্কুলে গেলে মিলাদ। পরীক্ষায় পাশ করলে মিলাদ, হোক সে নকল করে। চাকরি পেলে মিলাদ, হোক সে মামার জোরে কিংবা ঘুষ দিয়ে। মিলাদ যদি আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের জন্য হয়, তা তো ঘরে বসে একমনে নিজে নিজে করলেই হয়। লোক জড় করে, হুজুর ভাড়া করে, মিছিল করে শ্লোগান দিয়ে আদায় করার কী দরকার? আল্লায় কি কানে কম শোনে নাকি মিছিল মিটিংরে ডরায়?
এমনকি মানুষ মরে গেলেও মিলাদ পড়িয়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয় তবারকের নামে। মৃত্যুর কথা মনে হতেই আমি আঁতকে উঠি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি,
- কার মিলাদ?
- ফারুক মামার।
যে ভয় পাচ্ছিলাম। বউয়ের গলায় এখন বৃষ্টির ছাঁচ। যার মেজাজ যত গরম, তাঁর মন কি ততোই নরম হয়? নইলে আমার ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈয়ের মনে এত মায়া আসে কোথা থেকে? মাত্র তিন দিন হল মামা চলে গেছেন। এর মধ্যেই মিলাদের মিষ্টি? মামার মিলাদ নিয়ে কিছু বললে যদি বউ কষ্ট পায়, তাই ঘুরিয়ে বলি,
- আমি তো মিলাদ পড়িনি, তাহলে মিষ্টি পেলাম কী করে?
- তিন মসজিদে মিলাদ দিছে। সাতশো প্যাকেট তবারক বানাইছে। পাড়া প্রতিবেশীরেও দিছে। তোমারে এস্পেশালী পাঠাইছে।
বউয়ের গলায় এক ধরণের গর্বের সুর। আমি একটা জিলাপী মুখে তুলতে গিয়েছিলাম। শুনে নামিয়ে রাখি। মামার শেষ দিনগুলোতে আমি পাশে ছিলাম বলেই কি আমার জন্য এই স্পেশাল অফার? লোকটাকে আমি পছন্দ করতাম, শুধু আমি কেন? অনেকেই করত। সে বিনা পারিশ্রমিকে কলেজ মসজিদে আজান দিত। তার ডাক শুনে কত মানুষ নামাজ পড়তে আসত। হাজির হতো আল্লাহর দরবারে। তারা তো এমনিতেই মামার জন্য দোয়া করবে। তাহলে এই মিষ্টির ভেট কেন? তাছাড়া একটি শোক সন্তপ্ত দরিদ্র পরিবারের পক্ষে সাতশো তবারকের প্যাকেটের আয়োজন করা যে কতখানি কষ্টের, আল্লাহ কি তা জানেন না? তাহলে এই আয়োজনে আল্লাহ খুশি হবেন, ভাবি কী করে?
যে কোনো আলেম কিংবা ইসলামী চিন্তাবিদকে মিলাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেন এটা একটা বিদআত। রাসুল (সঃ) এর মৃত্যুর ছয়শো বছর পরে এর উৎপত্তি। এই প্রথা ইসলাম সম্মত নয়। অথচ মজার ব্যাপার হল, মিলাদ সব সময় একজন ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত মাওলানা কিংবা ইমাম সাহেবকে দিয়ে পড়ানো হয়। আমার জানা মতে কোনো ইমাম সাহেবকে বলতে শুনিনি, দোয়া চান, দোয়া করে দিচ্ছি। আমার হাদিয়া লাগবে না। মিষ্টি কিংবা তবারক দেয়ারও দরকার নাই। মামাকে মিথ্যা আশা দেখিয়ে যে ডাক্তার সাহেব ক্লিনিকে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন, তিনি আমার কলমের হাত থেকে রেহাই পাননি। তাহলে ঐ সব মসজিদের ইমাম সাহেবরা, যারা এই যে ইসলামের প্রথা বহির্ভূত কাজকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অনুমোদন দিলেন, তাদের নিয়ে যদি না লিখি, তাহলে আমার বিবেকের কাছেই তো আমি দায়ী হয়ে থাকব।
দোয়ার ব্যাপারে একবার বার্মিংহামের হাফেজ আঃ করিমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন,
- “আদ দুয়াউ মুখখুল ইবাদত”। দোয়া হলো সর্বোত্তম ইবাদত। কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো”।
- তাহলে যে আমরা প্রায়ই অন্যের কাছে দোয়া চাই?
হাফেজ সাহেব জবাব না দিয়ে হেসে উল্টো প্রশ্ন করেন,
- তুমি তো ডাক্তার। রুগীর কষ্ট তুমি রুগীর কাছ থেকে শুনতে পছন্দ করবে নাকি অন্যের কাছ থেকে?
- অবশ্যই রুগীর কাছ থেকে।
- তাহলে আল্লাহ তোমার ফরিয়াদ অন্যের কাছ থেকে শুনতে পছন্দ করবেন কেন?
- তবে যে শুনি বিশেষ বিশেষ মানুষের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন?
- তা করেন। তবে তার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যেমন ধরো মাতা পিতার দোয়া। তুমি যদি তোমার মা বাবার সেবা করো, তাদেরকে সুখে শান্তিতে রাখো, তারা খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে, আল্লাহ তা কবুল করবেন। মজলুমের দোয়া। যদি তুমি কারও উপর অত্যাচার করে, কষ্ট দাও, তার বদদোয়া আল্লাহ কবুল করবেন। মুসাফিরের দোয়া। তুমি এক ক্লান্ত, শ্রান্ত মুসাফিরকে কোনো কিছুর বিনিময় প্রত্যাশা না করে আশ্রয় দিলে, পানাহার করালে, সে খুশি হয়ে তোমার জন্য দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন।
- সেই জন্যই কি মসজিদে কিংবা বাড়িতে দোয়ার পরে মিষ্টি খাওয়ানো হয়?
- বোকা ছেলে! এটা একটা বিদআত। কারণ, প্রথমত যাদেরকে মিষ্টি খাওয়ানো হয়, তারা মুসাফির নয়। মুসল্লি কিংবা পাড়া প্রতিবেশী। দ্বিতীয়ত, যিনি বা যারা খাওয়ান, তারা নিজেরা সাধারণত পরহেজগার নন। এবং তারা সেটা ভালো করে জানেনে। তাই তারা মুসল্লিদের কাছে দোয়া চাইতে মিষ্টি খাওয়ান, যদি তাঁদের কথা খোদা শোনেন। এখন তুমিই বলো, তোমার প্রেসক্রিপশনের ওষুধ যদি রুগী না খেয়ে অন্যে খায়, তোমার দেয়া নিয়ম রুগী না মেনে যদি অন্যে মানে, তবে রোগ ভালো হবে? তাহলে যে বান্দা আল্লাহর দেয়া নিয়ম মত চলল না, অন্যেরা মিষ্টি বিরিয়ানি খেয়ে তার জন্য দোয়া করলেই কি আল্লাহ কবুল করবেন?
- তবে যে বলা হয়, এক মুসলমান ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে অন্য অন্য মুসলমান ভাই তার জন্য দোয়া করলে তা কবুল হয়?
- অবশ্যই হয়। তবে সেটা হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত দোয়া। ভিক্ষা করা কিংবা ফরমায়েশি দোয়া নয়। মনে করো, এক মুসলমান ভাই বিপদে আছে, কিংবা যুদ্ধে গেছে, অন্য মুসলমান ভাই তার অবর্তমানে তার জন্য দোয়া করল। আমি কি বোঝাতে পারলাম?
- হুম। তাহলে এই যে পৃথিবীতে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, নারী ও শিশু বিনা দোষে প্রাণ হারাচ্ছে, আর তাদের জন্য অযুত মসজিদে কোটি মুসলমান প্রতিদিন দোয়া করছে, আল্লাহ শুনছেন না কেন?
কিছুক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকেন বৃদ্ধ হাফেজ সাহেব। তার পর ম্লান হেসে বলেন,
- বড় জটিল প্রশ্ন করে ফেললে ডাক্তার। এর জবাব তো আল্লাহই ভালো দিতে পারবেন। তবে আমার মনে হয়, এর জন্য আমরাই দায়ী। পৃথিবীতে অমুসলমানদের হাতে মুসলমানরে যত নিহত হয়েছে, নিগৃহীত হয়েছে, তার চেয়ে মুসলমানদের হাতে মুসলমানরা বেশী নিহত হয়েছে নিগৃহীত হয়েছে এবং হচ্ছে। একজন পিতার পাঁচ জন সন্তান যদি সারাক্ষণ আত্মকলহে লিপ্ত থাকে, তখন সেই পিতার হাল ছেড়ে দিয়ে বসে বসে তামাসা দেখা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে? আমাদের কর্মফলেই আজ আমাদের এই অবস্থা।
- এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই?
- আছে। আত্মশুদ্ধি। অন্যের উপর আঙ্গুল না তুলে নিজেকে আয়নায় দেখো। নিজের খুত নিজে সংশোধন করো। অন্যের পয়সায় পরোপারের খেয়া পার হবার ধান্দা না করে নিজের কড়ি নিজে জোগাড় করো।
দোয়ার ব্যাপারে হাফেজ সাহেব আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। এর পর বহু বছর পার হয়ে গেছে। দেশে ফিরে দেখি মিলাদ মাহফিলের নাম বদলে দোয়া মাহফিল হয়েছে। তবে দোয়া চাওয়া ও দোয়া করার সিল সিলা এখনও জারি আছে। মসজিদে জুম্মার দিন এখন আর আগের মতো তবারকের মিষ্টি আসে না। হয়ত মিষ্টি খাইয়ে তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। ডিজিটাল যুগ। মানুষ এখন অনেক চালাক হয়ে গেছে। এখন মানুষ বিভিন্ন অজুহাতে ফেস বুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দোয়া চায়। মিলাদও পড়াতে হয় না। তোবারকের মিষ্টিও কিনতে হয় না। আবার মওলানা সাহেবদের হাদিয়াও দিতে হয় না। আল্লাহ ফেসবুকিং করেন কিনা আমি জানি না। ফেস বুকে এই দোয়া চাওয়া আর অন্যদের তাতে স্যাড ইমোজি দিয়ে “আমীন” লেখা আল্লাহ দেখতে পান কিনা, আমি তাও জানি না। তবে ফেসবুকে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে এই যে অন্যের করুণা ভিক্ষা করা, জাতি হিসেবে এটা আমাদের এক ধরণের হীনমন্যতা কিনা, আমি বুঝতে পারি না।
লেখকের কথা: আমি কোনো আলেম বা ইসলামী চিন্তাবিদ নই। আমি এক সাধারণ নাদান বান্দা, আমার কাছে যা ঠিক মনে হয়েছে তাই লিখেছি। কাউকে বা কোনো সম্প্রদায়কে হেয় করার জন্য নয়।