ড্যান্ডি

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****ড্যান্ডি*****

মূল লেখকঃ হায়দার আলী





২০২২ সাল। শীতের শুরু। মর্জিনা ওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসে মর্জিনার চুল গুলো উড়ছে। আজ মর্জিনার জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। কিশোরী মর্জিনার চোখে মূখে এত দিন যে রঙিন স্বপ্ন ছিল আজ সে স্বপ্ন ভেংগে চুরমার হয়ে গেছে। আজ থেকে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে তার যাত্রা শুরু হয়েছে।

চারটি লাল রঙের কুকুর। আসলে লাল রঙের কুকুর হয় না। বলা যায় বাদামী রঙ এর কুকুর। কুকুরগুলো বেশ নাদুস নুদুস। তারা ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করছে আর একটি কালো কুকুরকে তাড়া করছে। কালো কুকুরটি বাঁচার আকুতি নিয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। কিন্তু কিছুতেই তাদের আক্রমন থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। যতই চেষ্টা করছে তাদের আয়ত্বের বাইরে যেতে ততই যেন চতুর্মূখী আক্রমনে একে বারে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এই তল্লাটে সে নতুন এসেছে। হয়ত পথ ভুলে, অন্য কোন পরিস্থিতির কারনে বা খাবারের সন্ধানে বাধ্য হয়ে এসেছে।

মিরপুর এক নং গোল চক্কর। গোল চক্কর বললে ভুল হবে। বলা যায় তিন রাস্তা মোড়। উত্তরে মুক্ত বাংলা সুপার মার্কেট, পশ্চিমে ক্যাপিটাল সুপার মার্কেট আর পূর্বে কলওয়ালা পাড়া মসজিদের গলি। মাঝখানে সবার উপরে ত্রিমুখী ওভারব্রিজ।

লাল কুকুরগুলি তাদের আক্রমনের কৌশল সুন্দর ভাবে সাজিয়ে নিয়েছে। তিনজন ওভারব্রিজের তিন কর্নারে অবস্থান নিয়েছে আর একজন কালো কুকুরটিকে আক্রমন করছে। কালো কুকুর কোন দিক দিয়েই পালাবার সুযোগ পাচ্ছেনা। উপর্যোপরি আক্রমনে এখন সে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। লেজ গুঁটিয়ে আত্মসমর্পনের নিশানা প্রদর্শন করে নিজেকে কোন রকমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আর অপেক্ষা করছে হয়ত কোন গায়েবি শক্তি সহায়তা নিয়েএগিয়ে আসবে । কিন্তু এখানে তার কোন সাহায্যকারী নেই। সে একা।

অনেক কষ্টে সে একটা পজিশন নিয়েছে। মাঝের সড়ক দ্বীপের সাইড ঘেঁসে বসেছে। তার সামনে দিয়ে গাড়ি গুলো খুব দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। গাড়ির জন্য লাল বাহিনী সেখানে যেতে পারছে না। পরাজিত হয়েও কিছুক্ষনের জন্য সে কিছুটা নিস্তার পেয়েছে।

লাল বাহিনী নিজেরাও কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে। তাদের লম্বা জিব আরো লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে। তাদের নাদুস নুদুস শরীর হাঁপানীর তালে তালে দোল খাচ্ছে।

এই এলাকায় বেশ কিছু নামি দামী হোটেল আছে। সে সকল হোটেলের অনেক উচ্ছিষ্ট খাবার থাকে। ফুটপাতে আছে অনেক হাড় হাড্ডির হালিমের দোকান। এ সকল উচ্ছিষ্ট হাড় হাড্ডির মালিক এই লাল বাহিনী। বহিরাগত কোন কুকুর এই এলাকায় আসতে পারেনা। আসা মাত্রই তাদের আক্রমনের শিকার হতে হয়। আজকের এই বহিরাগতকে পরাজিত করতে পেরে তারা বেশ উল্লসিত। এই উল্লাস বিজয়ের উল্লাস। আঞ্চলিক আধিপত্ত বিস্তারের উল্লাস। "Happiness for the territorial dominance"

মর্জিনার বয়স আনুমানিক বার বছর। সে তার মাকে খুঁজতে এখানে এসেছে। সে এতক্ষণ ওভার ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আঞ্চলিক আধিপত্ত রক্ষার যে লড়াই এতক্ষণ হয়েছে তা সে গভীর মনোযোগ সহকারে দেখেছে। এই এলাকায় সেও আজ প্রথম এসেছে। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। কুকুরের ঝগড়া দেখে তার মনে ভর করেছে অজানা আশংকা আর ভয়। সেও কি এখানে আক্রমণের শিকার হবে? খুদা, ক্লান্তি আর ভয়ে কিশোরী মর্জিনার ছোট্ট শরীর বহিরাগত কালো কুকুরটির মতই নেতিয়ে পড়েছে। সে কোন রকমে রেলিং এ হেলান দিয়ে বসে পড়েছে। ক্লান্তি আর ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের জন্য সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

এই ভরদুপুরে ব্রিজের উপর দিয়ে মানুষের চলাচল অনেক কম। কেউ একজন মর্জিনাকে ভিক্ষুক ভেবে পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিয়েছে। কয়েন পড়ার শব্দে মর্জিনা আবার জেগে উঠেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে কয়েনটি হাতে তুলে নিয়েছে। ভাবছে আরো কিছুক্ষণ সে এভাবেই পড়ে থাকবে। যদি আরো কিছু কয়েন পাওয়া যায়! এভাবে কিছু টাকা জমলে সে রুটি কিনে খাবে। তারপর সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।

“এই নবাবের ছেরি উঠ, এই মর্জিনা, এই হারামজাদী, উডস না কেরে? উঠ। উঠে ভাত কইডা গিলে আমারে উদ্ধার কর”।

মর্জিনার মা মর্জিনাকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকছে। সে মিরপুরের কোন এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তুরাগ নদীর কুল ঘেঁষে বেড়ি বাঁধের বস্তির একটা টং রুমে মা মেয়ে থাকে। পাঁচ বছর আগে মর্জিনার বয়স যখন সাত বছর তখন মর্জিনার বাবা লাপাত্তা হয়েছে। সেই থেকে মা মেয়ের কষ্টের জীবন এখানেই অতিবাহিত হচ্ছে।

মর্জিনা লক্ষ্ করছে ইদানিং তার মা তার সাথে ভাল আচরণ করে না। শুনেছে গারমেন্টস এর এক সুপারভাইজারের সাথে তার মায়ের সম্পর্ক হয়েছে। তারপর থেকে মর্জিনার প্রতি মায়ের আচরণ কেমন যেন হয়ে গেছে। বস্তির অনেকে বলেছে, তোর মা তোকে ছেড়ে চলে যাবে, তুই এখন কি করবি? এসব কথায় মর্জিনা কান দেয় না। কান দিয়েও কোন লাভ নাই। যা হওয়ার তাই হবে।

“এই হারামজাদী উডসনা কেরে? তর বাপ যখন ভাইগা গেছে তখন হের লগে যাইতে পারস নাই? আমারে আর কত জ্বালাইবি? কাম নাই কাজ নাই, সারাদিন নদীতে ডুবাইতে যাইস। নদীতে ডুইবা মরতে পারস না? এই হারামজাদী উঠ, এই কুত্তার বাচ্চা কুত্তি, উঠ। উইঠা ভাত খা"।

মর্জিনার ঘুম ভাঙে । চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই। বুঝতে পারে এতক্ষণ যা ঘটেছে তা ছিল স্বপ্ন। মায়ের খোঁজে সে তুরাগ বস্তি থেকে এখানে এসেছে। আসার পরে কুকুরের ঝগড়া দেখেছে। তাই কুকুরের কিছু অংশ তার স্বপ্নের সাথে মিশে গেছে। মা তাকে কুত্তার বাচ্চা কুত্তি বলে গালি দিচ্ছে।

মনে হচ্ছে কুকুর আজ তার পিছু ছাড়বে না। সারাদিনের অভুক্ত শরীর। ঘুমিয়ে শরীরটা আরো দুর্বল হয়েছে । যে কুকুরের ভয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই কুকুর গুলোকে এখন সে সামনেই দেখতে পাচ্ছে। খুব কাছে। এত কাছে যে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে। সন্ধ্যার পরে কুকুরগুলো ব্রিজের উপর আশ্রয় নিয়েছে।

চারটি কুকুরের সাথে আরো চারটি ছেলে আছে। তারা মোটামুটি মর্জিনার সমবয়সী। বার চৌদ্দ বছর হবে। সবার হাতেই পলিথিনে মোড়ানো খাবার আছে। খাবার দেখতে অনেকটা হলুদ বর্নের। মর্জিনা বুঝতে পারছেনা তারা কি খাচ্ছে। খাচ্ছে কি না তাও ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। মুষ্টিবদ্ধ পলিথিনের মূখে মুখ লাগিয়ে ফু দিচ্ছে আবার নিশ্বাস নিচ্ছে। পলিথিন গুলো বেলুনের মত ফুলে উঠছে আবার চুপসে যাচ্ছে। এত তৃপ্তি সহকারে তারা কি খাচ্ছে মর্জিনা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। কিন্তু তার খিদা এতই বেশী যে লোভ সামলাতে পারছেনা। মর্জিনা তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

ছেলেদের একজন জিজ্ঞেস করছে, কিরে ডান্ডি খাবি? আগে খাইছস কোন দিন? তোর নাম কি?

আমার নাম মর্জিনা। আমার খুব ভুক লাগছে। তোরা কেউ আমারে কিছু খাইতে দে।

ছেলেগুলো সারাদিন কাগজ আর বোতল কুড়িয়ে ভাংগারির দুকানে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে খাবার আর ডান্ডি কিনে খায়। মাঝেমাঝে শাহ আলীর মাজারে গিয়ে শিরনী আর তবারক খায়। মর্জিনার ভুকের কথা শুনে তাদেরও খেতে ইচ্ছে করে। মুন্না বলে, চল আজকে মাজারে যাই। আজ না বিশ্যুদ বার! নিশ্চয়ই আজকে অনেক তবারক আসবে। এভাবেই শুরু হয় মর্জিনার নতুন জীবন।

নতুন জীবনে মর্জিনা খুব দ্রুতই অভ্যস্ত হয়। সাগর, মুন্না, সাকিব আর রাজু তার জীবন সাথি। আর আছে লাল বাহিনীর চার সদস্য। সারাদিন কাগজ আর বোতল কুড়ায়। দুপুরে সবাইকে নিয়ে তুরাগ নদীতে সাঁতার কাটে। সন্ধ্যায় মাজারের খাবার খেয়ে মুক্ত বাংলার সামনে থেকে দশ টাকার ডান্ডি কেনে। তারপর ওভারব্রিজে গোল হয়ে বসে শুরু হয় ডান্ডির নেশা। এ নেশা মরন নেশা। নিজের অতীত আর আপন জনদের ভুলে থাকার নেশা। তারপর ব্রিজের উপরে কাগজ কুড়ানোর বস্তা বিছিয়ে কুকুরকে বালিশ বানিয়ে দেয় শান্তির ঘুম।

এরই মাঝে সাগরের সাথে তার সখ্যতা একটু বেশী হয়। দুজনে মিলে ছুটে চলে শহর থেকে শহরতলি। কখনো দুজনে মিলে তুরাগ পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যায়। কুড়িয়ে আনে শাপলা, শালুক কখনো বা কাশফুল।

একদিন দুজনে মিলে মাজারে যায়। মাজারে অর্পন করে কুড়িয়ে আনা ফুল। মাজারকে স্বাক্ষী রেখে তারা হয় দুজন দুজনার।

২০২৩ সাল। মাঘ মাসের রাত। শীত ঝেঁকে বসেছে। ব্রিজের উপরে সবাই গা ঠাসাঠাসি করে বসে আছে। কুকুর গুলো তাদের গায়ের সাথে গা মিশিয়ে তাদেরকে কিছুটা ওম দিচ্ছে। সবার হাতে ড্যান্ডির পলি। তৃপ্তি সহকারে সবাই ড্যান্ডি খাচ্ছে। মর্জিনা ড্যান্ডি খেতে পারছেনা।

মর্জিনার কোল জুরে নবজাতক শিশু। মায়ের খোঁজে এসে সে আজ নিজেই মা হয়ে বসে আছে। সবাই বলছে কিরে মর্জিনা তোর পোলার নাম কি দিবি? মর্জিনার চোখে মূখে বিশ্ময়। যে নিজেই এখনো শিশু সে ভেবে পায় না কি দিবে ছেলের নাম। অবশেষে সাগর বলে, আমাদের ছেলের নাম দিমু 'ড্যান্ডি'।
 
Back
Top