ব্রিটেনে বৃদ্ধাশ্রম

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
133
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
ব্রিটেনে বৃদ্ধাশ্রম

মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন





ডিসেম্বর মাস। ব্রিটেনে রক্ত জমাট বাঁধা শীত। তাপমাত্রা শূন্যের নীচে। দমকা বাতাসের সাথে তুষার ঝড়। তুষারপাত ক্রমে আরও ভারি হচ্ছে। সামনে দশ হাতের বেশী দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির রেডিওতে ঘ্যাষঘ্যাষ শব্দ। বুঝি হেভি স্নোফলে ট্রান্সমিশন বিঘ্নিত হচ্ছে। তার মাঝেই শুনলাম, সতর্ক বাণী। একান্ত বাধ্য না হলে জনসাধারণ যেন ট্রাভেল না করে। একান্তই যদি ট্রাভেল করতে হয়, তবে যেন সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ গরম কাপড়, পানি, শুকনো খাবার ও গাড়ির ফুয়েল রাখে। বলছে, গত পঞ্চাশ বছরে এমন তুষারপাত হয়নি ব্রিটেনে।

ঝড়, বৃষ্টি, তুষার, তুফান, কোনো কিছুতেই ছুটি নেই ডাক্তারদের। সার্জারিতে (চেম্বার) রুগী দেখে এখন যাচ্ছি এক বৃদ্ধাশ্রমে। এরা বলে রেসিডেন্সিয়াল হোম। বাইরে দুপুর গড়িয়ে গেছে। অথচ স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলছে। তার আলো ঘন তুষারে শূন্যেই ঝুলে আছে। দুপাশে সিডার গাছগুলো তুষারের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায় নীরবে। দেশে ভরা পূর্ণিমায় যেমন জোছনার বন্যায় ভাসে চরাচর, এখানেও আজ তুষার কণায় আলো প্রতিফলনে কি এক মায়াবী আলো আঁধারীর খেলা চলে। আহা, প্রচণ্ড দুর্যোগেও প্রকৃতির কি অপূর্ব শোভা!

খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। একটু অসতর্ক হলেই স্কিড করে আছড়ে পড়ব রাস্তার বাইরে। দশ মিনিটের রাস্তা কচ্ছপের মত গুটি গুটি করে আধ ঘণ্টায় পৌঁছুলাম। বেল টিপতেই রেসিডেন্সিয়াল হোমের স্টাফ দরজা খুলে দিল। যেন ঠাণ্ডা নরক থেকে উষ্ণ স্বর্গে প্রবেশ করলাম। এই সব হোমে যারা থাকে, তাদের বয়স আশি থেকে একশোর মধ্যে। কেউ কেউ সেঞ্চুরিও পুরো করে ফেলে। তখন তারা রাণীর কাছ থেকে কংগ্রাচুলেশনস লেটার পায়। আমি মাঝে মাঝে কৌতুক করে বলি, আর ক’টা বছর টিকে থাকো। রাণীর চিঠি নিয়ে তবেই স্বর্গে যেও। দারোয়ান তোমাকে বিনা হিসাবেই স্বর্গে ঢুকতে দেবে। স্টাফরা সহানুভূতির হাসি হাসে। স্মৃতি বিস্মৃত রুগীটি আমার কৌতুক না বুঝতে পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে, কিংবা হাসে আনমনে।

এই হোমটির প্রায় সবাই ডিমেনসিয়ার রুগী। বয়সের ভারে স্মৃতি হারিয়ে শিশুর মত হয়ে গেছে। নিজ বাড়িতে নিজের দেখাশুনা করতে পারে না। ছেলে মেয়েরা ব্যস্ত যে যার জীবনে। তাদের সময় কোথায় বুড়ো বাবা মার দেখাশুনা করার? তাই ঠাঁই হয়েছে রেসিডেন্সিয়াল হোমে। আমরা স্বাস্থ্যের দিকটা দেখি, সোশ্যাল সার্ভিস দেখে বাকিটা। শিশুরা যেমন আমার খুব প্রিয়, তেমনই খুব প্রিয় শিশুর মত সরল এই বয়োবৃদ্ধ মানুষগুলো। করিডোরেই মিসেস মুরের সাথে দেখা হয়ে গেল। কাপড় চোপড় পড়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে, হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে, পায়চারি করছে আর ক্ষণে ক্ষণে কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরে দেখছে। বললাম,
- হ্যালো মিসেস মুর, গুড আফটারনুন। আর ইউ ওয়েটিং ফর সামওয়ান?
- ইয়াপ, ওয়েটিং ফর মাই সান। উইল গো ফর শপিং।

যতবার এই হোমে এসেছি, ততবারই দেখেছি, মিসেস মুর সেজে গুজে অপেক্ষা করছেন ছেলের জন্য। শপিঙে যাবেন। ছেলে আর আসে না। স্টাফদের কাছে শুনেছি, মিসেস মুরের দুই ছেলে। দূর শহরে থাকে। বছরে দু একবার আসে। বাকি সময় টেলিফোনে খোঁজ খবর নেয়। বার্থ ডে, মাদার্স ডে, ক্রিস্টমাস ডেতে কার্ড পাঠিয়ে দেয়। বছরের পর বছর যায়। কার্ডের স্তূপ জমা হয়। ছেলেরা দু একবার এলেও স্মৃতিভ্রষ্ট মাকে নিয়ে তাদের শপিঙে যাওয়ার সময় হয় না। অথচ এই মা তাঁর ছেলেদের কতবার কত কারণে অকারণে শপিঙে নিয়ে গেছেন। করেছেন সন্তানের কত শখ, কত স্বপ্ন পূরণ। অথচ মিসেস মুরের শপিঙে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় না। হয়তো হবেও না কোনদিন।

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে নার্সিং স্টেশনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
- কেমন আছে আমার রোগীরা? কাকে কাকে দেখতে হবে?
সিনিয়র নার্স জেস বলল,
- ইউ নিড টু সি মিস ব্রাউন ফার্স্ট। শী ইজ পুওরলী। ইন ডাইং ফেজ।

মিস এলিজাবেথ ব্রাউন। সবাই ডাকে বেটি। মিস। কারণ বিয়ে করেননি। কেন করেননি জানা হয়নি। যৌবনে কোন নিদারুণ দুঃখে পরিবার বিমুখ হয়েছিলেন, কেউ জানে না। নেই কোনো ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন। শুধু এক প্রতিবেশী আসে প্রতিদিন। এ এক অদ্ভুত দেশ। পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই আলগা হয়ে যাচ্ছে। অথচ নাইবারহুড বন্ডেজ স্ট্রং হচ্ছে দিনে দিনে। এখানে প্রতিবেশীরাই বিপদে আপদে এগিয়ে আসে। অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকে কিংবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। উইক এন্ডে শপিং করে দেয়। জীবন বুঝি এভাবেই একজনের শূন্যতাকে আরেকজন দিয়ে পূরণ করে দেয়।

মিস ব্রাউন সারা জীবন বেঁচেছেন স্বাধীন ভাবে, নিজের মতো করে। এক সময় প্রতিবেশীরা লক্ষ করল, বেটি নিজ বাসা ভুলে অন্য বাসার কড়া নাড়ছে। দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ছে। সেই প্রতিবেশী তখন ডাক্তারকে খবর দিল, বোঝা গেল দুরারোগ্য ডিমেনশিয়া গ্রাস করছে ততদিনে। সোশ্যাল সার্ভিসকে খবর দেয়া হল। একা একা বাসায় থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তাকে এনে ভর্তি করে দিল এই রেসিডেন্সিয়াল হোমে। সাত আট বছর আগে। ব্রিটেনে সোশাল সার্ভিসেস বেশ অর্গানাইজড। যার কিছু নেই, কেউ নেই, স্টেট রান সোশাল সার্ভিস আমৃত্যু তার দেখাশুনা করে। যেমন করছে মিস ব্রাউনকে। প্রথম প্রথম বাড়ি ফিরে যাবার জন্য বেশ বায়না ধরত। তারপর একদিন ভুলেই গেল তার নিজের কোনো বাড়ি আছে। আমি তাকে দেখছি গত তিন বছর ধরে। শেষ দিকে দেখতাম, চুপচাপ বসে থাকত জানলার ধারে। উদাস চোখে চেয়ে থাকত আকাশের দিকে। কে জানে, ওরও কি ইচ্ছে করত পাখির মত ডানা মেলে আকাশে উড়তে? ইচ্ছে করত আমার মত ছেলেবেলায় ফিরে যেতে? গাছ যেমন পানি না পেয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়, বেটিও তেমনি আমার চোখের সামনে দিনে দিনে নিস্তেজ হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এলো।

আমি জেসের সাথে বেটির রুমে গেলাম। বেডে শুয়ে আছে মিস এলিজাবেথ ব্রাউন, বেটি। এক সময় যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। রোগে শোকে সে সৌন্দর্য কবেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। বেডের উপর পড়ে আছে কংকালসার শরীরটা। বেডের পাশেই বসে আছেন মার্গারেট। বেটির সেই সহমর্মী প্রতিবেশী। সত্তরের কাছাকাছি বয়স। আট বছর আগে পাশাপাশি থাকতেন। বেটির বাড়ি কবেই সোশাল সার্ভিসেস টেক ওভার করে নিয়েছে, রেসিডেন্সিয়াল হোমের খরচ মেটাতে। সে বাড়িতে বাস করে এখন অন্য কেউ। অথচ মার্গারেট এখনও প্রতিদিন এসে বসে থাকে এক সময়ের প্রতিবেশী, বন্ধু, বেটির কাছে। আমি বেটির বেডের কাছে গেলাম। এখনো জ্ঞান আছে। চোখ দুটো আধ খোলা। ঢিমেতালে বইছে শ্বাস। বেটির পালস দেখলাম। টিক টিক করে এখনো চলছে জীবনের কাঁটা। বেটির শীর্ণ হাতটা ধরে বললাম,
- হাউ আর ইউ ব্রেভ গার্ল?

বেটির হাতটা একটু কেঁপে উঠল। বুঝি আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে চাইল। শক্তিতে কুলাল না। আমিই ওর হাতটায় মৃদু চাপ দিলাম। একটু ম্লান হাসল বেটি। বুঝি বলতে চাইল কিছু। গলা দিয়ে কোনো কথা বের হল না। শুধু একটু ঘরঘর শব্দ বের হল। জিজ্ঞেস করলাম,
- এনি পেইন বেটি?
এদিক ওদিক অল্প মাথা নাড়ল। দুচোখের কোন বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সেকি চলে যাওয়ার কষ্টে নাকি আমাকে কিছু না বলতে পারার কষ্টে, বুঝতে পারলাম না। আমি ওর কষ্ট আর দেখতে পারলাম না। এই হাতের উপর দিয়ে কত প্রিয় প্রাণ চলে গেছে না ফেরার দেশে। আমি আর কাউকে বিদায় দিতে চাই না। আমি বেটিকে আর কিছু না বলেই বাইরে চলে এলাম। কী বলতাম আমি? বেটি চিন্তা করো না, সময় আর নেই বাকি?

মার্গারেটও আমাদের সাথে বাইরে এলো। জিজ্ঞেস করল,
- হাউ লং ডক্টর?
- মে বি টুনাইট। মে বি কাপল অব ডেজ। ডিফিকাল্ট টু সে।
ছলছল করে উঠল মার্গারেটের চোখ, বন্ধুর চির বিদায়ের যন্ত্রণায়। আর কিছু না বলে বেটির কাছে ফিরে গেল। জেসকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আর অল এন্ড অব লাইফ মেডিকেসনস রেডি?
- ইয়েস ডক্টর।

এন্ড অব লাইফ মেডিকেসনস। এ দেশের ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী মৃত্যুর আগে মরফিন, ডায়াজিপাম জাতীয় কিছু ইনজেকশন ককটেল বানিয়ে সিরিঞ্জ ড্রাইভারের মাধ্যমে দেয়া হয়। যাতে মৃত্যুকালে মানুষটার প্রাণ পাখি ঘুমের মধ্যেই যন্ত্রণাহীন ভাবে চলে যেতে পারে। মৃত্যু যন্ত্রণা কেমন আমি জানিনা। সে যন্ত্রণা কি শরীরের নাকি আত্মার? তাও আমি জানিনা। পৃথিবীর কোনো ব্যথানাশক কি কমাতে পারে আত্মার যন্ত্রণা? আমি সত্যি জানিনা। তাই ব্যক্তিগত ভাবে আমি এ প্রথা তেমন মানি না। প্রায়ই বলি,
- রুগীর যদি ব্যথা না থাকে, বা খুব বেশী ছটফট না করে, তবে ও সব দিও না। প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে যেতে দিও।

জেসকে বেটির ব্যাপারে একই কথা বললাম। যদি সম্ভব হয়, প্রিয় বন্ধুর হাতে হাত রেখে চলে যাক সে অজানার ঠিকানায়। মনে মনে বললাম, খোদা, যেদিন মৃত্যু দেবে, শুধু এইটুকু দয়া কর আমায়, সজ্ঞানে, দুচোখ খুলেই যেন সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি। প্রিয় মানুষগুলো ব্যথাতুর মুখ দেখতে দেখতেই যেন ঢলে পড়ি চিরনিদ্রায়।

কী অদ্ভুত পেশা আমার? আনন্দে উচ্ছ্বাস দেখাতে পারি না। অনধিকার কৌতূহল দেখাতে পারি না। এমনকি দুঃখ পেলে কাঁদতেও পারি না। আমি যেন মানুষ নই। আমি বুঝি অন্য কেউ। আই আ্যাম জাস্ট আ প্রফেশনাল। মনের সব অনুভূতি বুকের ভেতর কবর দিয়ে, মুখের উপর প্রফেশনালিজমের মুখোস ঝুলিয়ে জেসকে জিজ্ঞেস করলাম,
- হু ইজ নেক্সট?
- মিঃ উইলিয়ামস। ফ্যামিলি ইজ হিয়ার। দে থিংক হি ইজ ডিপ্রেসড।

বিরক্ত লাগে আমার। বুড়ো মানুষটাকে একা একা রেসিডেন্সিয়াল হোমে ফেলে রেখেছে। ডিপ্রেসড হবে না তো খুশিতে ধেই ধেই করে নাচবে? ডাক্তারের কাছে এরা কি আশা করে কে জানে? এক আনডিউ এক্সেপেক্টশনের মুখোমুখি হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে মিঃ উইলিয়ামসের রুমে গেলাম। হ্যারোল্ড উইলিয়ামস। হ্যারি ডাক শুনতে পছন্দ করেন। হ্যারির রুমে যেয়ে দেখি, বসেছে চাঁদের হাট। আজ এই দুর্যোগের মধ্যেও তার দুই মেয়েই এসেছে। এসেছে নাতি নাতনী সবাই। বড় মেয়েকে দেখেই মেজাজটা বিগড়ে গেল। স্কুলে মাস্টারি করে। সব দেশেই মাষ্টাররা বুঝি নিজেদের বেশী বুদ্ধিমান মনে করে। আর পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে মনে করে তাদের ছাত্র ছাত্রী। সুযোগ পেলেই জ্ঞান দান করে। তার উপর যোগ হয়েছে ইন্টারনেট। নেট ঘেঁটে ঘেঁটে কত কী যে ইনফরমেশন জোগাড় করে। আর মিলিয়ে দেখে বাপের সাথে। ইন্টারনেটে যা লেখা, তা যেন বাইবেলের বাণী। ভেবে দেখে না, ইন্টারনেটে আমার মতই কোনো বোকার হদ্দ লিখেছে ওসব ছাইপাঁশ।

মিসেস মুরের ছেলেরা বছরে সর্বোচ্চ দু’বার আসে। আর মিঃ উইলিয়ামসের মেয়েরা কমপক্ষে দিনে দু’বার আসে। সে বিবেচনায় মিঃ উইলিয়ামস তো মহা ভাগ্যবান। দুর্ভাগ্য তো আমাদের। মিসেস মুরকে আমাদের মতো করে চিকিৎসা দিতে পারি। কিন্তু মিঃ উইলিয়ামসের বেলায় তা পারি না। সারাক্ষণ এটা হলো কেন, ওটা হলো না কেন, এটা দিলে কেন, ওটা দিলে না কেন, স্টাফদের নাভিশ্বাস করে রাখে। আরে বাবা, এতই যখন দরদ, কাছে নিয়ে রাখলেই পারিস।

আমাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় মেয়ে এ্যান বলল,
- আমরা কি সবাই বাইরে চলে যাবো ডক্টর?
- না না, ঠিক আছে। তোমাদের সঙ্গ থেকে ওকে বঞ্চিত করতে চাই না। টেল মি, হোয়াটস ইওর কর্নসার্ন?
- আই থিংক, হ্যারি ইজ বিট ডিপ্রেসড।

এ দেশে ছেলে মেয়েরা মাঝে মাঝে মা বাবাকে নাম ধরে ডাকে। এ্যানের কথা শুনে আমি হ্যারির দিকে তাকালাম। অশীতিপর বৃদ্ধটির দুপাশে বসে আছে তার পরীর মত সুন্দর দুই ষোড়শী নাতনী। কী যেন শুনে হাসছে হ্যারি ফোকলা মুখে। এক সময় আর্টিফিশিয়াল দাঁত ছিল। গিলে ফেলতে পারে ভেবে খুলে রাখা হয়েছে। খুশিতে চকচক করছে ধুসর দুই চোখ। বয়স তার স্মৃতি কেড়ে নিয়েছে. হয়ত মুছে দিয়েছে প্রিয় মানুষগুলোর নাম, মুছতে কি পেরেছে প্রিয়জনের মুখ? হেসে বললাম,
- হ্যারিকে তো আজ খুব হ্যাপি দেখাচ্ছে। একটুও ডিপ্রেসড লাগছে না।
- সে তো আমরা এসেছি বলে।
- তুমি কিন্তু নিজেই জবাব দিয়ে দিলে!
কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকল এ্যান। বুঝি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল। বলল,
- আমি জানি তুমি কী বোঝাতে চাইছ ডক্টর। আমারও ইচ্ছে করে ড্যাডকে আমার কাছে রাখি। আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ দুজনেই চাকরি করি। বাচ্চারা সারাদিন স্কুলে। ড্যাড একা একা বাসায় সেফ নয়। তাই তো এখানে রাখি। আমরা দুবোন পালা করে দিনে দুবার আসি।

এ্যানের গলা কি একটু ধরে এলো? চিকচিক করল কি চোখের কোন? পৃথিবীর সব মেয়েরাই বুঝি বাবাকে এমন করেই ভালবাসে। এই প্রথম এ্যানকে খুব ভাল লাগল আমার। এই প্রথম একটা মেয়ে না থাকার জন্য খুব কষ্ট হল। এ্যানকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে এলাম।

মনটা কেমন অবসাদ লাগছে। এত ঘটনা একদিনে মনটা হজম করতে চাইছে না। মনকে বোঝাই, অত নখরা করিস না। ডাক্তারদের মন টন থাকতে নেই। ভাগ্যিস, মনের নখড়ামি কেউ দেখতে পায় না। আমি নির্বিকার কণ্ঠে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম,
- এনি মোর?
জেস বোধহয় আমার মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করল। তাড়াতাড়ি বলল,
- জাস্ট ওয়ান। মিসেস গোর কিছু খাচ্ছে না।

মিসেস মৌরিস গোর। ডাকে মৌরিস বলে। আমার ইচ্ছে করত, নামটা কেটে মৌরি কিংবা মৌ করে দেই। কি সুন্দর মিষ্টি নাম হয়ে যেত। তবে মনে মনে তাকে আমি মৌরি বলেই ডাকি। মৌরিকে ভীষণ পছন্দ আমার। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রঙ। লাল কাপড় খুব পছন্দ তার। প্রায়ই লাল একটা কার্ডিগান পড়ে থাকে। কার্ডিগানের লাল আভা তার ফর্সা মুখে যেন আবীর ছড়িয়ে দেয়। ছোটখাটো শরীর। একটা ওয়াকিং স্টিক হাতে টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায় সারা বাড়িময়। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে। আপন মনে নিজের সাথে কথা বলে। বেশ আছে সে। এই দুনিয়ার দুঃখ কষ্ট ভুলে আপন ভুবনে। একমাত্র ছেলে পাশের শহর ম্যানচেস্টারে থাকে। উইকেন্ডে এসে মায়ের সাথে কাটিয়ে যায়। একাই। মাঝে মাঝে বাইরে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়। সেদিন তার সেকি আনন্দ। ইন্ডিয়ান কারি তার খুব পছন্দ। আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে, এই চাঁদের মা বুড়িটাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাই। আমার বউয়ের মজাদার ইন্ডিয়ান রান্না খাওয়াই। শোভন অশোভনের বেড়াজালে কত ইচ্ছাই পূরণ হয় না কখনো!

ঘরে ঢুকে দেখি, চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে আমার লাল টুকটুক পরী, মৌরি। সামনে ছোট্ট গোল কফি টেবিলে দুপুরের খাবারগুলো অভুক্ত পড়ে আছে অবহেলায়। কাপে চায়ের উপর পড়েছে সর। একপাশে গ্লাসে অরেঞ্জ জুস। আমাকে দেখে আজ আর হাসল না। কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে আমার। কোনো অসুখ করেনি তো? হাঁটু গেড়ে ওঁর চেয়ারের পাশে বসলাম। আমার হাতটা ওঁর হাতের উপর রাখি। নাহ, জ্বর নেই। ঠাণ্ডা হাত। জিজ্ঞেস করলাম,
- মৌরিস, তুমি নাকি কিছু খাচ্ছ না?

কিছু না বলে তেমনি শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল মৌরি। বুঝলাম আজ কথা বলার মুড নেই। ডিমেনশিয়া রোগীদের স্মৃতি হারিয়ে যায়। মনটা হারায় না। শিশুর মতো হলেও মন তো মনই থাকে। সে মন উদাস তো হতেই পারে অব্যক্ত কোনো কারণে। আমরা বলি আপস এন্ড ডাউনস অব ডিমেন্টেড মাইন্ড।

আমি একটা হাত মৌরির মাথায় রাখলাম। অন্য হাতে জুসের গ্লাসটা ওর মুখের কাছে ধরে নরম গলায় বললাম,
- মৌরিস, প্লিজ, ড্রিংক।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাধ্য মেয়ের মত অনেকখানি জুস খেয়ে নিলো মৌরি। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, “নিজের ভাল পাগলেও বোঝে”। আজ আমার মনে হল, স্মৃতি হারালেও মানুষ মমতাটা ঠিকই টের পায়। আমি উঠে দাঁড়িয়ে জেসের চোখে চোখ রাখি। যেন বলতে চাইছি, আমার হাতে তো ঠিক খেল। আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে জেস চোখ নামিয়ে নিলো। মেজাজটাকে অনেক কষ্টে বশে এনে ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
- জেস, ডু ইউ হ্যাভ এনি কিড?

বছর তিরিশেক বয়স জেসের। লম্বা একহারা ব্রিটিশ গড়ন। নার্স হিসেবে খুব দায়িত্বশীল। সারাক্ষণ দু পায়ের উপরই থাকে। আমাদের দেশের মত নার্সিং ষ্টেশনে বসে আড্ডা মারে না। আমাকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয় না কখনও। একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
- ইয়েস ডক্টর। টু।
- হাও ওল্ড আর দে?
- থ্রি এন ফাইভ।
- ওরা খেতে না চাইলে তুমি কী করো? ওদের আদর করে খাইয়ে দাও। নয়ত পারস্যু কর। এই বুড়ো মানুষগুলো স্মৃতি হারিয়ে কিডস হয়ে গেছে। ইউ গট টু ফিড দেম, পারস্যু দেম টু ইট এন ড্রিংক।
- স্যরি ডক্টর। উই আর বিট শর্ট অব স্টাফ।
- দেন টেল ইউর অথরিটি। দ্যাটস হোয়াট দে পে ফর। দ্যাটস হোয়াট ইউ আর পেইড ফর।

কী যে হয়েছে আমার? শেষের দিকে নিজের কথাগুলো নিজের কানেই কেমন রূঢ় শোনায়। তাকিয়ে দেখি ছলছল করছে জেসের নীল চোখ। এমন রূঢ় আচরণে অভ্যস্ত নয় সে। নিজের আচরণে নিজেই লজ্জা পেলাম। বললাম,
- আই আ্যাম স্যরি। ডিডিন্ট মিন ইউ পারসোনালী।
- ইটস ওকে ডক্টর। আই ক্যান আন্ডারষ্ট্যান্ড। ডোন্ট ওরি, আই উইল টেক কেয়ার অব হার।
- থ্যাংকস জেস। মাচ এপ্রিসিয়েটেড।

শীতে মানুষের রোগশোক বাড়ে। বাড়ে আমাদের ব্যস্ততা। পরদিন অফিসে গিয়ে কাজে ডুবে গেলাম। বেটি মৌরিদের কথা ভুলে গেলাম। সকাল এগারোটার দিকে খবর এলো, মিস ব্রাউন হ্যাজ পাসড আ্যওয়ে। আমাকে যেতে হবে ডেথ কনফার্ম করার জন্য। এমনটা হবে জানতাম। তাই অবাক হলাম না। হাতের কাজ বাকি রেখেই হোমের পথ ধরলাম।

মিসেস মুরকে আজ দেখলাম না করিডোরে। বুঝি সাজগোজ করছে শপিঙে যাওয়ার জন্য। আজও জেসই আছে ডিউটিতে। বলল,
- বেটি হাজ লেফ্ট আস।
আপাদমস্তক প্রফেশনাল ব্রিটিশ নার্স জেসের চোখ কি একটু চিকচিক করে উঠল? এ হোমের বাসিন্দারা শেষ জীবনের কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর এই এক জায়গাতেই কাটিয়ে দেয়। জেসদের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও কেমন যেন এক আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তাই বুঝি অনুভূতিটা পুরাপুরি আড়াল করতে পারল না জেস। আমিও দীর্ঘশ্বাসটা চেপে বললাম, চলো।

একা একা শুয়ে আছে বেটি। নিথর, নিস্তব্ধ। দৃষ্টিহীন চোখ দুটো খোলা, স্থির। হাতে সিরিঞ্জ ড্রাইভার নেই। কথা রেখেছে জেস। এন্ড অব লাইফ মেডিকেশনস দেয়নি। চোখ খুলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে বেটি। আমি ওর চোখদুটো বন্ধ করে দিলাম। এ দেশে ডাক্তার মৃত্যু নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ডেড বডি স্পর্শ করার নিয়ম নেই। জিজ্ঞেস করলাম,
- কখন?
- হাফ এন আওয়ার।
আমি নিয়মমাফিক পরীক্ষা করলাম। বন্ধ হয়ে গেছে জীবন ঘড়ির কাঁটা। নিজের ঘড়ি দেখে বললাম,
- ডেথ কনফার্মড এট ইলেভেন থার্টি।
যখনই মারা যাক না কেন, এটাই অফিসিয়াল টাইম অব ডেথ। চারিদিকে তাকালাম। মার্গারেটকে কোথাও দেখতে পেলাম না। জানতে চাইলাম,
- মার্গারেটকে দেখছি না। ও জানে?
- ম্যাগি সারা রাত ছিল। সকালে ফ্রেস হতে বাড়ি গিয়েছে। ফোন করে দিয়েছি। শী উইল বি হেয়ার এনি টাইম।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল মারগারেট। আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
- স্যরি ডক্টর। আই কুডুন্ট বি উইথ বেটি এট দ্যা লাস্ট মোমেন্ট।

কোনো আহাজারি নয়। কোনো উচ্চস্বরে কান্না নয়। শুধু ছলছল করছে ম্যাগির চোখ। বুঝি সারা রাত পাশে থেকেও শেষ মুহূর্তে কাছে থকতে না পারার অপরাধ বোধে ভুগছে। আমি একটা হাত ম্যাগির কাঁধে রাখলাম। একটু সান্ত্বনার মৃদু চাপ দিয়ে বললাম,
- দুঃখ করো না ম্যাগি। তুমি কাছে থাকলে তোমাকে ছেড়ে যেতে হয়ত ওর কষ্ট বেশী হত।
- আমি কি বেটির হাতটা কিছুক্ষণ ধরে বসে থাকতে পারি?
ম্যাগির কণ্ঠে অনুনয়। প্রিয় বন্ধুর হাতটা একটু ছুঁয়ে থাকার আকুলতা। আস্বস্ত করে বললাম,
- ওহ শিওর। যতক্ষণ খুশি তুমি বেটির কাছে থাকতে পারো।

আমরা মারগারেটকে বেটির সাথে কিছুটা সময় একা থাকতে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেটির শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হবে…
 
Back
Top